মহৎ যে কোনো সৃষ্টির পিছনে তাকালে দেখা যাবে সেখানে ব্যক্তি বা ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে । উদ্যোগের সাথে উদ্যম ও সৃজনশীলতা জড়িত। কোনো সমাজে যদি মানুষ উদ্যোগী না হয়, উদ্যম হারায় তবে সেখানে সৃজনশীলতা উৎসাহিত হয় না । ফলে ঐ সমাজ পশ্চাৎপদ সমাজে পরিণত হয়।
তাই ভালো উদ্যোগ যেন সর্বত্র এগিয়ে যেতে পারে, মানুষ যেন উদ্যোগী হতে উৎসাহী হয় সে পরিবেশ সৃষ্টি করা রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। ব্যবসায় যে কোনো দেশে মানুষের রোজগারের প্রধান খাত, আয় কর্মসংস্থানের মুখ্য উপায় এবং উন্নয়নের অন্যতম অবলম্বন । তাই ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক । আগামী দিনে যারা উদ্যোক্তা হয়ে গড়ে উঠবে সেই শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ব্যবসায় উদ্যোগ বিষয়টি ভালো করে জানতে হবে । তাদের হৃদয়পটে যেন ভালো উদ্যোক্তা হওয়ার বাসনা জন্মে, উদ্যোক্তাদের যেন তারা . সম্মান করতে শেখে এজন্য প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে তাদের ধারণা দেয়া উচিত ।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা (শিখন ফল)
১. উদ্যোগের ধারণা ও ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা করতে পারবে
২. ব্যবসায় উদ্যোগের বৈশিষ্ট্য ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করতে পারবে
৩. সফল উদ্যোক্তার গুণাবলি বর্ণনা করতে পারবে
৪. আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তার গুণাবলি শনাক্ত করতে পারবে
৫. ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশ বিশ্লেষণ করতে পারবে
৬. আত্মকর্মসংস্থান ও উদ্যোগের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারবে
৭. আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যবসায় উদ্যোগের অবদান বিশ্লেষণ করতে পারবে
৮. বাংলাদেশে ব্যবসায় উদ্যোগ উন্নয়নে সমস্যা এবং তা দূরীকরণের উপায় ব্যাখ্যা করতে পারবে
৯. বাংলাদেশের সফল উদ্যোক্তাদের জীবনী পাঠের মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণে অনুপ্রাণিত হবে
১০. বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা বর্ণনা করতে পারবে
১১. বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে কিছু সুপারিশ করতে পারবে
পণ্য বা ধারণা উদ্ভাবন
নতুন বাজার সৃষ্টি করা
কাঁচামালের উৎস চিহ্নিতকরণ
তহবিলের উৎস নির্ধারণ
নিষ্ঠা
আন্তরিকতা
প্রজ্ঞা
সাহসীকতা
i ও ii
.i ও iii
ii ও iii
i, ii ও iii
ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা
নমনীয়তা
স্বাধীনচেতা মনোভাব
সৃজনশীলতা
i ও ii
i ও iii
ii ও iii
i, ii ও iii
বন্যায় এলাকার একটা বাঁধ ভেঙ্গে মানুষের চলাচলে কষ্ট হচ্ছে। সরকার কবে মেরামত করবে তা বলা যাচ্ছেনা । সামনে বৃষ্টি শুরু হলে মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। মি. আলম এলাকার হৃদয়বান মানুষ । তিনি এ সমস্যা নিয়ে গণ্যমান্য অনেকের সাথে কথা বললেন। ছাত্র, যুবক ও সাধারণ মানষের সাথে কথা বলে বাঁধটা নিজেরা সবাই মিলে মেরামত করা যায় কি না সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করলেন। এরই এক পর্যায়ে একদিন স্কুল মাঠে একটা সভা হলো। গণ্যমান্য অনেকেই কথা বললেন। ছাত্র ও যুবকদের পক্ষ থেকেও কেউ কেউ উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্য রাখলো । সিদ্ধান্ত হলো যারা পারবে টাকা দেবে এবং ছাত্র ও যুবকরা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে বাঁধ মেরামত করবে । একদিন সকালে নারী-পুরুষ শিশুসহ সবার উপস্থিতিতে কাজ শুরু হলো । সবার মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ। শুধু বাঁধ মেরামত হলো না গ্রামের মধ্যে রাস্তায় যেখানে যা সমস্যা ছিল তাও সংস্কার হয়ে গেলো । এক্ষেত্রে মি. আলমের কর্মপ্রচেষ্টা উদ্যোগের একটা উদাহরণ।
কোনো নতুন চিন্তা মাথায় রেখে যখন কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তা বাস্তবায়নের প্রয়াস নেন তাকে উদ্যোগ বলে । উদ্যোগের সাথে নতুন চিন্তা, নতুন কিছু করার বিষয় জড়িত । যা প্রয়োজন অথচ নেই, যা নতুন করে শুরু করলে তা ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য, দেশ ও দশের জন্য, ব্যবসায়ের জন্য বা এমন কোনো ক্ষেত্রের জন্য মঙ্গলকর হবে- এমন কিছু করার চেষ্টা-প্রচেষ্টা উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত । উদ্যোগের সাথে ইতিবাচক কিছু করার সম্পর্ক বিদ্যমান । চৌধুরী বাড়ির লোকেরা গ্রামে স্কুল করেছে তাই তালুকদার বাড়ির লোকেরা প্রয়োজন ছাড়াই গ্রামে আরেকটি স্কুল করার প্রয়াস নিয়েছে- এটা উদ্যোগ নয় বরং উদ্যোগকে বাধা দেয়ার অপচেষ্টা মাত্র। তুমি যে কলেজে পড়ছো, খোঁজ নিয়ে দেখো এটার পিছনে কারও না কারও বা অনেকের উদ্যোগ কাজ করেছে । আজ যে বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দেখছো, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল, ক্লাব ইত্যাদি দেখছো- তার প্রতিষ্ঠার পিছনেও কারও চিন্তা-ভাবনা, শ্রম ও মেধা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে নিঃসন্দেহে। তাই উদ্যোক্তার ধারণা ব্যাপক বিস্তৃত। তবে Entrepreneurship ইংরেজি শব্দটি ব্যবসায় উদ্যোগ বা শিল্পোদ্যোগ বুঝাতেই এখন কার্যত ব্যবহৃত হয়।
উদ্যোগের সাথে চিন্তার সফল বাস্তবায়নও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। উদ্যোগ যখন ব্যর্থ হয় তখন সাধারণভাবে ঐ উদ্যোগ আর মূল্যায়িত হয় না। তবে অনেক সময় উদ্যোগ সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে নতুন উপায় বা পদ্ধতির অনুসরণে উদ্যোগ সফল বলে পরিগণিত হয়। সেক্ষেত্রে নতুন ও পুরানো সকল প্রচেষ্টায় উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে । মি. আলী গ্রামে একটা কলেজ করার উদ্যোগ নিয়ে জমি দান করলেন, টাকা-পয়সা জোগাড় করে বিল্ডিং তৈরি করলেন। কিন্তু শিক্ষার্থী না পাওয়ায় তা বন্ধ হয়ে গেলো। ঐ গ্রামের বাসিন্দা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মি. ভৌমিক চাইলেন মি. আলীর তৈরি স্থাপনায় স্কুল শুরু করবেন । মি. ভৌমিক এলাকার কিছু উদ্যমী যুবক ও তার পুরনো ছাত্রছাত্রীদের সাথে নিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে লেগে পড়লেন । বাড়ি বাড়ি যেয়ে ছাত্রছাত্রী যোগাড় করলেন। এক বছর পরই স্কুলের শিক্ষার্থী বেড়ে গেলো । পাঁচ বছরের মাথায় স্কুলটি উপজেলা পর্যায়ে সুনাম কুড়িয়েছে। আর পাঁচ বছর যেতে না যেতেই স্কুলে একাদশ ও বাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু করা যাবে। এক্ষেত্রে মি. আলী ও মি. ভৌমিকের উদ্যোগকে একত্রেই বিবেচনা করতে হবে।
মানুষ বুদ্ধিদীপ্ত জীব । সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ নানান বৈরি পরিবেশ মোকাবেলা করে পথ চলেছে। নিজস্ব বাস্তবতায় সর্বোচ্চ সুবিধাকে কাজে লাগানোর জন্য মানুষ গ্রহণ করেছে বিভিন্ন প্রয়াস-প্রচেষ্টার। সফলতা- বিফলতার ধারায় সফলতা অর্জন করেই এগিয়ে গেছে মানুষ। নিত্য-নতুন সৃষ্টি আর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে জীবনকে করেছে সুষমামণ্ডিত । তাই উদ্যোগ মানব জীবনের শুরু থেকেই বর্তমান ছিল- এটা বলার অপেক্ষা রাখে না । তবে ব্যবসায় উদ্যোগের শুরু হয়েছে বেশ পরে। ব্যবসায় উদ্যোগ ধারণার ক্রমবিকাশ নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. প্রাচীন যুগ (Ancient period) : মানুষ সংঘবদ্ধ হওয়ার পর নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তির ও একত্রে প্রয়োজন পূরণের জন্য চাষবাস, পশুপালন, পশুশিকার, মাছশিকার-এভাবে নানান উপজীবিকা গ্রহণ করে । নিজেদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন অন্যের সাথে বিনিময়ের ব্যবস্থা করে প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা চালায় মানুষ। ধীরে ধীরে কামার, কুমার, তাঁতী-এভাবে নানান সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এ সকল কাজ যে মানুষের নতুন চিন্তা ও উদ্যোগের একেকটা ফসল তা বলার অপেক্ষা রাখে না । সমাজ আরও সংহত হলে ধাতব মুদ্রার প্রচলন ঘটে । এতে মুদ্রা দিয়ে কেনা- বেচা শুরু হওয়ায় মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য দৃশ্যমান হয় । একক মালিকানার ভিত্তিতে নানান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে । নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হওয়ায় উৎপাদন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটে । ব্যবসায় বড় হওয়ায় যৌথ সামর্থ্যের সম্মিলনে অংশীদারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ প্রাচীন যুগেই বিস্তৃতি লাভ করে । তবে ব্যবসায় উদ্যোগ একটা আলাদা বিষয় হতে পারে তা মানুষের চিন্তায় তখনও স্থিতিলাভ করেনি।
২. মধ্য যুগ (Middle age): যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুর পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক ধারাতেই বিকাশ লাভ করে। বণিক শ্রেণি পালতোলা নৌকায় বা উটের পিঠে পসরা সাজিয়ে একস্থান থেকে অন্যত্র মালামাল বেচা-কেনা করলেও ব্যবসায় উদ্যোগ ধারণা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়নি। একাদশ ও দ্বাদশ শতকে ইতালিতে ব্যবসা-বাণিজ্য নতুনভাবে বিকশিত হলে উৎপাদনের পদ্ধতিগত উন্নয়নের পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসায় বিকাশ লাভ করে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটে। সপ্তদশ শতকে এসে ইউরোপের আরও কিছু দেশ ব্যবসায়ে উন্নতি লাভ করলে বৈদেশিক ব্যবসায়ে ত প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। ফলে ব্যবসায় বা শিল্প-বাণিজ্য অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এর সুবাদে ব্যবসায় উদ্যোগ ধারণা মানুষের মনে স্থান নিলেও তা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়নি ।
৩. আধুনিক যুগ (Modern stage): আধুনিক যুগ বলতে অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লব শুরুর পর থেকে সমসাময়িক কালকে বুঝায় । যান্ত্রিক শক্তির উন্মেষ এ সময়ে শিল্প বিপ্লবে মুখ্য ভুমিকা রাখে । এই যান্ত্রিক শক্তির উদ্ভব ছিল সেই সময়ের এক অপরিহার্য দাবি। কারণ কায়িক শ্রম এবং পশুশক্তি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যবসায় উন্নয়নের তৎকালীন গতিধারার সাথে সংগতি বিধানে সক্ষম ছিল না। বাজারে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির তুলনায় উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ায় এই চাহিদা পুরণে অনেকেই নতুন নতুন ব্যবসায় গড়ে তা পূরণের চেষ্টা চালায় । ফলে ব্যবসায় উদ্যোগ বা নতুন ব্যবসায় গড়ার ভাবনা সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এ প্রেক্ষিতেই 'ব্যবসায় উদ্যোগ' বা 'শিল্পোদ্যোগ' ধারণা আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় । এই পর্যায়ে উক্ত বিষয়ে ধারণার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
উদ্যোগ ধারণার ক্রমবিকাশের আলোচনা শেষে সংক্ষেপে বলা যায়, সমাজ উন্নয়নের সাথে উদ্যোগ ধারণা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। তবে ব্যবসায় উন্নয়নের ধারা যত দ্রুততর হয়েছে উদ্যোগ বা শিল্পোদ্যোগ ধারণার উন্নয়নও ততই সামনে এসেছে। এখন উদ্যোগ ধারণা নতুন কিছু সৃষ্টির সাথে জড়িত যেখানে উদ্যোক্তা অনিশ্চয়তা মেনে নিয়ে নতুন পণ্য, ধারণা ও বাজার সামনে রেখে সফলতা লাভে অগ্রসর হন।
কৃষক পরিবারের সন্তান শহীদুল। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে পরিবারের অভাব-অনটন। জমি যা আছে বংশ তাতে ফসল হলে কষ্ট হওয়ার কথা নয় কিন্তু বন্যা, খরা, ফসলের দাম নেই নানান সমস্যা লেগেই থাকে। তার জ ক্লাসমেটের বাবাকে সে ছয় বছর আগে থেকেই দেখছে। জমি-জায়গা তেমন নেই। গ্রামের বাজারে ছোট দোকান। দিব্যি সংসার চলছে। এসএসসি পাস করে সে ব্যবসায় করবে ভাবলো। সবাই দোকানদারি করে। তার ভিন্ন কিছু করার চিন্তা। এলাকায় বিদ্যুৎ এসেছে। কাঠ বাদ দিয়ে মানুষ স্টীলের দরজা-জানালা, আলমারি ইত্যাদির দিকে ঝুঁকছে। সে শহরে যেয়ে ছয় মাস ওয়েল্ডিং এর কাজ শিখলো । কিছু টাকা জোগাড় করে গ্রামের বাজারে ছোট্ট একটা ঘর নিয়ে 'শহিদুল ওয়েল্ডিং' নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললো । পরিশ্রম আর ঐকান্তিকতায় সে এখন উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত । শহরে একটা কারখানা করার কথা ভাবছে সে ।
যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ব্যবসায় বিষয়ে নতুন চিন্তা মাথায় নিয়ে তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হন তাকে ব্যবসায় উদ্যোক্তা বলে। ব্যবসায় উদ্যোক্তা বা শিল্পোদ্যোক্তার ধারণা অনেকটা ব্যাপক। সুরুজ মিয়া বাজারে চালের দোকান দিয়েছে । সে উদ্যোক্তা কি না এটা চিন্তার বিষয় । কারণ বাজারে অনেকেই চলে বিক্রয় করছে। সেও চালের দোকান দিল, এতে নতুনত্ব নেই । এখন যদি এমন হয়, সে নওগাঁর চালের মোকাম থেকে ট্রাকে চাল এনে বাজারের দোকানদারদের কাছে বিক্রয় শুরু করলো; যা এর আগে ঐ বাজারে কেউ করেনি । তাহলে এখানে সৃজনশীল চিন্তা, অধিক ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা ইত্যাদি কাজ করেছে। এখন তাকে ব্যবসায় উদ্যোক্তা বলতে সমস্যা নেই । মিলন শেখের বাজারে চাল ও আটার মিল রয়েছে। সে ভাবলো যদি চিড়া তৈরির কল বসানো যায় তবে তা ভালো চলতে পারে। এই নতুন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া যুক্ত করায় সেও উদ্যোক্তা। মিতু প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় এমব্রয়ডারি কারখানা গড়ে তুললো, হাফিজ মৌ-চাষ করে মধু সংগ্রহ ও তার ব্যবসায় শুরু করলো এক্ষেত্রে মিতু ও হাফিজ ব্যবসায় উদ্যোক্তার উদাহরণ। মপিটার উদ্যোক্তা সাধারণ ব্যবসায়ী নন, পেশাদার ব্যবস্থাপকও নন বরং তার চেয়ে বেশি কিছু। তাঁরা সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করে ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যেতে আনন্দবোধ করেন। অন্যের অধীনে চাকরি না করে অধিক মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারলেই খুশী হন। ছোট দিয়ে শুরু করেন বটে কিন্তু তার চিন্তা ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তিনি নতুন নতুন ব্যবসায় বা শিল্প গড়ে তুলতে পারলেই তৃপ্ত হন। তাঁর চিন্তায় মননে, স্বপ্ন ও শয়নে সাফল্য অর্জনের চিন্তা তাড়া করে ফেরে। এমন উদ্যোক্তা শ্রেণি যে কোনো দেশের জন্যই নিঃসন্দেহে বড় সম্পদ ।
ভারতের টাটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জামশেদ টাটা, KFC এর প্রতিষ্ঠাতা Harland Sanders, Walmart এর প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ওয়াল্টন বিশ্বসেরা উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে জহুরুল ইসলাম, আকিজ মিয়া, স্যামসন এইচ চৌধুরীর মতো উদ্যোক্তাগণ আমাদের গর্বের ধন। তাঁদের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে তারাও একদিন ছোট উদ্যোক্তা হিসেবেই ব্যবসায় শুরু করেছিলেন ।
উদ্যোগ একটা সাধারণ পরিভাষা। নতুন কোনো বিষয়ে যিনিই কোনো প্রয়াস নিয়ে সামনে এগিয়ে যান তাকেই উদ্যোক্তা হিসেবে দেখা হয়। একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা, স্কুলে কলেজ শিফট চালু, এলাকায় স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন, গ্রামের বাজারে মোবাইল ব্যাংকিং এর চেইন পয়েন্ট চালু, মহল্লায় বিউটি পার্লারের দোকান খোলা-এর সবই উদ্যোগের উদাহরণ। দু'পক্ষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ, রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ এগুলোও উদ্যোগেরই আওতাভুক্ত। অন্যদিকে উদ্যোগের যেই অংশ ব্যবসায়ের সাথে জড়িত তাকে ব্যবসায় উদ্যোগ বলে । নতুন ব্যবসায় গঠন বা নতুন পণ্য, সেবা, পদ্ধতি বা বাজার সামনে রেখে একজন ব্যবসায়ীর উদ্যোগকে ব্যবসায় উদ্যোগ বলা হয়ে থাকে। উদ্যোগের বিষয়বস্তু অনেক ব্যাপক । অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক যে কোনো বিষয়েই উদ্যোগ গৃহীত হতে পারে। কিন্তু ব্যবসায় উদ্যোগের বিষয়বস্তু নতুন ব্যবসায় শুরুর সাথে সম্পর্কিত। এটি সম্পূর্ণ নতুন ব্যবসায় হতে পারে, নতুন পণ্য বা সেবা ব্যবসায়ে সংযুক্ত করার প্রয়াস হতে পারে, নতুন প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি চালু করা হতে পারে, নতুন বাজারে প্রবেশ প্রচেষ্টা হতে পারে- এর সবকিছুর সাথেই যেহেতু নতুন চিন্তা যুক্ত তাই এগুলো ব্যবসায় উদ্যোগের অন্তর্ভুক্ত । উদ্যোগের উদ্দেশ্য মূলত জনকল্যাণ কিন্তু ব্যবসায় উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন । অধিকাংশ উদ্যোগের ক্ষেত্রে সাধারণত আর্থিক ঝুঁকির সম্ভাবনা তেমন থাকে না কিন্তু ব্যবসায় উদ্যোগের ক্ষেত্রে আর্থিক ঝুঁকির সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে ।
নতুন কোনো ধারণা বা চিন্তা নিয়ে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যখন কোনো ব্যবসায় শুরুর প্রয়াস চালায় তাকে ব্যবসায় উদ্যোগ বলে। ব্যবসায় অন্যান্য উপজীবিকা থেকে ভিন্নতর। এর উদ্দেশ্যও অন্যান্য কাজ থেকে আলাদা। তাই ব্যবসায় উদ্যোগ অন্যান্য উদ্যোগ থেকে প্রকৃতিগতভাবেই ভিন্ন প্রকৃতির । নিম্নে এর প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো :
১. মুনাফা অর্জন সংশ্লিষ্ট (Relatedness with profit) : উদ্যোগ যে কোনো কল্যাণকর ও ইতিবাচক দিকের সাথে সম্পর্কযুক্ত হলেও ব্যবসায় উদ্যোগ বিশেষভাবে মুনাফা অর্জন সংশ্লিষ্ট। এরূপ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন ও সাফল্য লাভের প্রয়াস চালায়।
২. ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার আধিক্য (Excessiveness of risk and uncertainty) : গতানুগতিক ব্যবসায়ে ঝুঁকি স্বভাবতই কম থাকে । কারণ এক্ষেত্রে পূর্বেই ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা কমবেশি মূল্যায়ন করা যায় । কিন্তু নতুন চিন্তা ও ধারণা নিয়ে যখন কেউ ব্যবসায়ে নামে তখন তার সম্ভাবনা ও সমস্যাগুলোকে আগাম সেভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। সে কারণে দেখা যায় ব্যবসায় উদ্যোগ অনেক সময়ই বিফল হয়।
৩. নতুন ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত (Relatedness with new idea) : নতুন ধরনের ব্যবসায়, নতুন পণ্য বা সেবা, নতুন প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি, নতুন বাজার ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখে ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় । এই নতুনত্বের পিছনে উদ্যোক্তার সৃজনশীলতা কাজ করে। ব্যবসায় উদ্যোগ সে বিচারেই গতানুগতিক ব্যবসায় গঠনের চেয়ে ভিন্নতর ।
৪. কৃতিত্ব অর্জনে বিশেষ সম্মান লাভ (Gaining special honour for achievment) : মানুষ বিভিন্ন ভাবেই জীবনে সাফল্য বা উন্নতি লাভ করতে পারে। কিন্তু সর্বত্রই কৃতিত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশেষ সম্মান লাভ ঘটে না । একটা এলাকায় নতুন এক ধরনের ব্যবসায় গড়ে তুলে কেউ যদি সাফল্য লাভ করে বা কোনো ব্যবসায়ীর নতুন উদ্যোগ সফল হয় তখন তার যোগ্যতার স্বীকৃতি মেলে ও তার বিশেষ সম্মান লাভ ঘটে । প্রয়াত রণদা প্রসাদ সাহা, মরহুম জহুরুল ইসলাম সেই কৃতিত্বের বলেই আমাদের মাঝে টিকে থাকবেন অনেকদিন ।
৫. সাফল্যের ইতিবাচক ফল যথেষ্ট (Sufficiency of positive result for success) : ব্যবসায় উদ্যোগ সফল হলে তা উদ্যোক্তার মধ্যে ব্যাপক অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের জন্ম দেয় । তদুপরি তার উদ্যোগ সর্বত্র প্রশংসিত হওয়ায় তা তাকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে । তার সাফল্য ধাপে ধাপে তাকে বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠনের দিকে নিয়ে যায়। তাকে দেখে অনেকেই নতুন উদ্যোগ নিতে অনুপ্রাণিত হয় । অর্থাৎ ব্যবসায় উদ্যোগের সফলতা ব্যক্তির সাথে দেশ ও দশের জন্যও ব্যাপক কল্যাণ বয়ে আনে ।
৬. উদ্যোগ গতানুগতিক ব্যবসায় কর্মকাণ্ড নয় (Entrepreneurship is not traditional business activities): ব্যবসায় উদ্যোগ গতানুগতিক ব্যবসায় গঠন থেকে ভিন্ন কিছু । বাবার ব্যবসায়ে পুত্র বসা শুরু করলো, অনেক চালের ব্যবসায়ীর মাঝে একজন চালের ব্যবসায় শুরু করলো- এগুলো ব্যবসায় উদ্যোগের মধ্যে পড়ে না। যখন কেউ নতুন পণ্য, সেবা, পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে বাজারে নামে তখন তাকে অনেক বেশি চিন্তা ও পরিশ্রম করতে হয় এবং ঝুঁকি নিতে হয়। সাফল্যার্জনে তার আগ্রহ ও চেষ্টা থাকে ভিন্নতর ।
ব্যবসায় উদ্যোগ হলো নতুন ধারণা ও চিন্তা নিয়ে ব্যবসায় গড়ে তোলার উদ্যোগ বা কর্মপ্রচেষ্টা। এর মূলে থাকে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে একটা সফল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠন ও পরিচালনা করা। যাতে উদ্যোক্তার আয়- রোজগারের পাশাপাশি তা তার ক্যারিয়ার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়। এরূপ চেষ্টা-প্রচেষ্টার মধ্যে যে সকল কাজ সম্পাদনের প্রয়োজন পড়ে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. উদ্যোগ চিন্তার উন্নয়ন (Development of entrepreneurship thinking) : ব্যবসায় উদ্যোগ সৃজনশীল চিন্তার সাথে সম্পর্কযুক্ত। অন্য ব্যবসায়ী কোন ব্যবসায়ে ভালো করছে, সে দিকটা দেখার চাইতে নিজে কোন ব্যবসায় গড়ে তুললে ভালো করতে পারবে একজন উদ্যোক্তা সে দিকটা দেখতেই আগ্রহী থাকে । নতুন কী করলে ব্যবসায়ে দ্রুত সাফল্য লাভ সম্ভব হবে- সে বিষয় তার কাছে প্রাধান্য পায়। এভাবেই সে নানান চিন্তাকে বিচার-বিবেচনা করে উদ্যোগ চিন্তার উন্নয়ন ঘটায়।
২. সম্ভাব্যতা যাচাই ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Testing feasibility and taking decision) : উদ্যোগ চিন্তা কতটা কার্যকর হবে এটা দেখার জন্য একজন উদ্যোক্তাকে নানান সুবিধা-অসুবিধা চিন্তা করতে হয় । চিন্তাকে একটা প্রকল্প বিবেচনা করে এতে সম্ভাব্য বিনিয়োগ, খরচ, আয় ও মুনাফা কী হতে পারে তা বিশ্লেষণ করা হয়। লাভজনকতা বিচারে নতুন প্রকল্প চিন্তা গ্রহণযোগ্য হলে তা বাস্তবায়নে উদ্যোক্তা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ।
৩. অর্থসংস্থান (Financing) : যে কোনো নতুন ব্যবসায় উদ্যোগে অর্থসংস্থানের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । একজন উদ্যোক্তা তার নতুন চিন্তার বিষয়ে খুবই উৎসাহী ও আশাবাদী থাকেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার অর্থসংস্থানের সামর্থ্য সীমাবদ্ধ থাকে। এজন্য ব্যবসায় উদ্যোগে কখন কী পরিমাণ অর্থ লাগবে, কোন কোন উৎস থেকে উক্ত অর্থ সংগ্রহ করা যাবে তা সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে অর্থ সংগ্রহ, বিনিয়োগ, নগদ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজ করতে হয়।
৪. ঝুঁকি গ্রহণ (Taking risk) : ব্যবসায় উদ্যোগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঝুঁকি গ্রহণ । ব্যবসায় উদ্যোগে যেহেতু নতুন পণ্য, সেবা, পদ্ধতি, বাজার ইত্যাদিকে সামনে নিয়ে আসা হয় ফলে তার কার্যকারিতা কতটা ফলদায়ক হবে এ নিয়ে স্বভাবতই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেশি থাকে। এজন্যই একজন উদ্যোক্তাকে অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হয় । এই ঝুঁকিকে পিছনে রেখে সাফল্য অর্জনে তাই একজন উদ্যোক্তা অনেক বেশি প্রত্যয়ী ও কর্মতৎপর থাকেন।
৫. উপকরণাদি সংহতকরণ (Organizing resources) : ব্যবসায় উদ্যোগকে সফল করতে অর্থ ছাড়াও বিভিন্ন উপকরণ: যেমন- শ্রম, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি জোগাড় এবং সেগুলো সঠিকভাবে সমন্বিত করার প্রয়োজন পড়ে । এক্ষেত্রে জনশক্তি সংগ্রহে উদ্যোক্তাকে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। এক্ষেত্রে একবার ভুল করলে উদ্যোগ এগিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানে উত্তম নিয়ম-পদ্ধতি গড়ে তোলা না গেলে পরবর্তীতে প্রতি পদে পদে সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়।
৬. বাজার সৃষ্টি (Creating market) : বাজার সৃষ্টি বলতে মূলত নির্দিষ্ট এলাকায় চাহিদা সৃষ্টির কাজকে বুঝায়। নতুন পণ্য বা সেবা বাজারজাত করতে চাইলে উক্ত পণ্য বা সেবাকে ক্রেতা সাধারণের নিকট জনপ্রিয়। করে তুলতে হয় । নতুন ব্যবসায় শুরু করলে সম্ভাব্য গ্রাহকদের ঐ ব্যবসায়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলার প্রয়োজন পড়ে। সম্ভাব্য গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলার জন্য উত্তম পণ্য ও সেবার পাশাপাশি উত্তম আচরণ, গ্রাহকদের সুবিধামতো মূল্য ও শর্ত নির্ধারণ, প্রচার ও যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদি নানান কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে । এভাবে একবার বাজার সৃষ্টি করা গেলে উদ্যোগ এগিয়ে নেয়া সহজতর হয় ।
৭. সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়ন (Evaluation of success & failure) : ব্যবসায় উদ্যোগে সাফল্য লাভ করতে হলে কাজ শুরুর পর প্রকল্পের প্রতিটা পর্যায়ে এর সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে । সাফল্যে অভিভূত না হয়ে সাফল্যকে ধরে রেখে কিভাবে সামনের দিকে আরও এগিয়ে যাওয়া যায় একজন উদ্যোক্তাকে তা নিয়ে ভাবতে হয় । কোন কোন দিক থেকে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন পড়ে। অন্যদিকে যদি ব্যর্থতা লক্ষ করা যায় তবে সমস্যা মূল্যায়ন করে তা সমাধানে দ্রুত কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
৮. উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন (Execution of development program) : ব্যবসায় উদ্যোগে সফলতা ধরে রাখতে উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট সতর্ক ও আন্তরিক হওয়ায় প্রয়োজন পড়ে । মনে রাখতে হয় “সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের হাজার ফোঁড়' অর্থাৎ নতুন পণ্য, সেবা, পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে গ্রাহকদের মধ্যে যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে এটাকে যতদ্রুত সম্ভব মানুষের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন । এক্ষেত্রে কোনোরূপ আলস্য প্রতিযোগী সৃষ্টির পথ খুলে দিতে পারে । তাই উন্নয়ন কর্মসূচিকে একটা পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে নেয়া ছাড়া ভিন্ন কিছু ভাবার কোনো সুযোগ থাকে না ।
ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুমাননির্ভর পথযাত্রায় যে উদ্যোক্তা তার নতুন ব্যবসায় চিন্তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়ে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হন তাকেই সফল উদ্যোক্তা বলে। সফল উদ্যোক্তা নিঃসন্দেহে একজন সৃজনশীল উদ্ভাবক, উত্তম সংগঠক, যোগ্য পরিচালক ও সফল নেতা । তিনি সাধারণ ব্যবসায়ী বা ব্যবস্থাপক থেকে ভিন্নতর । বিভিন্ন গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সমাহারে তিনি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। নিম্নে একজন সফল উদ্যোক্তার বিভিন্ন গুণ বা বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:
১. সৃজনশীল মানসিকতা বা সৃজনশক্তি (Creative mentality): নতুন কিছু চিন্তা করার এবং তা দিয়ে একটা ধারণাকে দাঁড় করাতে পারার মতো ব্যক্তির মানসিক সামর্থ্যকে সৃজনশীল মানসিকতা বা সৃজনশক্তি বলে। একজন উদ্যোক্তা অন্যেরটা সম্পূর্ণ অণুকরণ করেন না । হতে পারে তিনি অন্যের কাজ দেখে তাতে নতুন কিছু সংযোজন করতে পারেন । নতুন কোনো ব্যবসায় দাঁড় করাতে পারেন । নতুন পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ইত্যাদি সংযোজন করতে পারেন। নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারেন-যার সবকিছুর জন্য সৃজনশীল মনসিকতা বা সৃজনশক্তি অপরিহার্য বিবেচিত হয় । অর্থাৎ একজন ভালো উদ্যোক্তা নতুন কিছু সৃষ্টি করার মতো সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক মনের অধিকারী হয়ে থাকেন ।
২. কৃতিত্বার্জন চাহিদা (Need of achievement): একজন ব্যক্তির মধ্যে কৃতকার্যে সাফল্য লাভের প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে কৃতিত্বার্জন বা সাফল্যার্জন চাহিদা বলে। কোনো ব্যক্তি যদি তার কাজ থেকে সাফল্য প্রত্যাশা না করেন, দৌড় দিয়ে যদি প্রথম হওয়ার স্বপ্ন না দেখেন তবে ঐ কাজে তার সর্বোচ্চ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও আত্মত্যাগ থাকে না । তাই একজন সফল উদ্যোক্তা সাফল্য অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও আশাবাদী মন নিয়ে পথ চলেন । তিনি তার উদ্যোগ প্রচেষ্টাকে নিজের জীবনে সাফল্য লাভের উপায় বা ক্যারিয়ার হিসেবে গণ্য করেন এবং সকল প্রচেষ্টায় তার এ স্পৃহার প্রতিফলন ঘটে ।
৩. দূরদৃষ্টি (Fore-sight): জ্ঞানচক্ষু বা বিশেষ জ্ঞান (প্রজ্ঞা) দ্বারা ভবিষ্যৎকে উপলব্ধি বা বুঝতে পারার সামর্থ্যকে দূরদৃষ্টি বলে । একজন ব্যক্তি তার নতুন চিন্তার সাফল্য সম্ভাবনা যদি বুঝতে না পারেন, সমস্যা কী হতে পারে যদি ভাবতে না পারেন তবে তার পক্ষে কখনই ভালো উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব নয়। কবীর হোসেন অন্যের সাফল্য দেখে কোনো ব্যবসায়ে নেমে পড়লো। কিন্তু ঐ ব্যবসায়ের ভবিষ্যত সম্ভাবনা কী, কী ধরনের বাধাগুলো আগামী দিনে ঐ ব্যবসায়কে মোকাবেলা করতে হবে- এগুলো যদি বোঝার মতো ভাবার মতো সামর্থ্য তার না থাকে তবে তার পক্ষে ব্যবসায় করা সম্ভব নয়; ব্যবসায় উদ্যোক্তা হওয়াতো দূরের কথা ।
৪. সাহস ও বুদ্ধিমত্তা (Bravity and intallectual): নির্ভিকভাবে পথ চলতে পারার গুণকেই সাহস বলে । অন্যদিকে, মানুষের বোধশক্তি ও বিচারশক্তিকে বুদ্ধিমত্তা বলা হয়ে থাকে। বোধশক্তিসম্পন্ন একজন মানুষ যদি করণীয় ঠিক করে সাহসীকতার সাথে তা অর্জনে পথ চলতে পারে তবে তার পক্ষে সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়। অন্যদিকে যদি দুই পা চলে আর এক পা পিছায়, সবসময় অজানা ভয় যদি কাউকে তাড়া করে ফেরে তবে তার পক্ষে ভালো উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব হয় না । ঝুঁকিপূর্ণ, অনুমাননির্ভর ও অচেনা পথে কার্যত জীবনকে বাজি রেখে একজন উদ্যোক্তা তার উদ্যোগ চিন্তাকে বাস্তবায়ন করেন। এ জন্য একজন উদ্যোক্তাকে যথেষ্ট সাহসী হতে হয় । তার এ সাহস অবশ্যই বুদ্ধিমত্তা দ্বারা সুষমামন্ডিত হয়ে থাকে ।
৫. ধৈর্য ও কষ্টসহিষ্ণু (Patience and hardworking): যে গুণের প্রভাবে একজন মানুষ বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রতিকূলতা সহ্য করে নিজ লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে তাকে ধৈর্য্য বলে। অন্যদিকে দুঃখ ক্লেশ, বেদনা ইত্যাদি সইতে পারার গুণকে কষ্টসহিষ্ণুতা বলা হয়ে থাকে। একজন উদ্যোক্তা নতুন ব্যবসায়, পণ্য, পদ্ধতি, বাজার ইত্যাদি নিয়ে যখন কাজ করে তখন প্রত্যাশিত অবস্থার বাইরে বিরূপ অবস্থা তাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে । হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সে অবস্থাতেও যদি ভেঙ্গে না পড়ে, অবিচল থেকে, ধৈর্য ধরে এবং দুঃখ ও বেদনাকে সহ্য করেও একজন উদ্যেক্তা করণীয় নির্ধারণপূর্বক এগিয়ে যেতে পারে তবে তার পক্ষে সাফল্যলাভ সম্ভব হয় । তাই ধৈর্য এবং সেই সাথে কষ্টসহিষ্ণুতা উদ্যোক্তার বড় গুণ । তাই সহজেই ধৈর্য হারান বা ভেঙ্গে পড়েন এমন মানুষ কখনই ভাল উদ্যোক্তা হতে পারে না ।
৬. ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা (Risk taking mentality): আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনাকে ঝুঁকি বলে । এই ক্ষতি মেনে নেয়ার মতো মনকেই উদ্যোক্তার ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা বলে। যে কোনো নতুন উদ্যোক্তার ঝুঁকির বা ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি থাকে । তাই সাফল্য আসবেই এবং কখনই ক্ষতি স্বীকার করতে হবে না এমন চিন্তা উদ্যোক্তাকে বাস্তবতার গুণ বর্জিত করে তোলে । তাই একজন উদ্যোক্তার ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা একটি বড় গুণ । চাকরিজীবী ও গতানুগতিক ব্যবসায়ীদের সাধারণত এ ধরনের মানসিকতা থাকে না। একজন উদ্যোক্তা তার সময়, শ্রম ও পুঁজিকে সমন্বিত করে এবং বিভিন্ন দায়ের বোঝা মাথায় নিয়ে উদ্যোগকে এগিয়ে নেন । এরূপ মানসিকতাই তাকে এক্ষেত্রে সাহস জোগায় ।
৭. সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য (Ability to take decision): বিভিন্ন বিকল্প করণীয় থেকে বাস্তবতার আলোকে উত্তম করণীয় নির্বাচন করতে পারার গুণকেই সিদ্ধান্তে গ্রহণের সামর্থ্য বলে। যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য একজন সফল উদ্যোক্তার বড় গুণ । কোনো উদ্যোগ গ্রহণ থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে হাজারো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। সম্ভাব্য সমস্যা, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদির যথাযথ মূল্যায়ন করেই এ সকল সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিলম্ব বা দুর্বলতা পুরো উদ্যোগকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
৮. নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা (Dutyfulness and Sincerity): কর্তব্য-কর্মে দৃঢ় অনুরাগ, আস্থা, বিশ্বাস, মনোযোগ ইত্যাদিকে নিষ্ঠা বলে । অন্যদিকে অকৃত্রিমতা, কপটতামুক্ততা, লোক দেখানো ভাব পরিহার করে কাজ করাকে আন্তরিকতা বলা হয়ে থাকে। একজন সফল উদ্যোক্তাকে অবশ্যই তার কাজে নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক হতে হয় । নিষ্ঠা তাকে নিজস্ব কাজে আস্থাবান, মনোযোগী ও দায়িত্বশীল করে তোলে। এটি তার আচরণে যে প্রভাব ফেলে তা অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণে যেমনি সমর্থ হয় তেমনি ক্যারিয়ার গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । অন্যদিকে নষ যখন দেখে কোনো ব্যক্তি তার কাজে প্রকৃতই নিষ্ঠাবান এবং কোনো ধরনের কপটতা বা কৃত্রিমতা তার মধ্যে নেই। তখন অন্যরা তাকে সহযোগিতা করতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে থাকে ।
৯. যোগাযোগ দক্ষতা (Communication ability) : অন্যের বা অন্যদের নিকট সঠিক সময়ে সঠিক উপায় বা পদ্ধতিতে নিজের বক্তব্য বা প্রয়োজন কার্যকরভাবে তুলে ধরে উদ্দেশ্য অর্জনের সামর্থ্যকে যোগাযোগ দক্ষতা বলে । সফলতা অর্জনে একজন উদ্যোক্তাকে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে । এ কারণেই যোগাযোগ দক্ষতা একজন সফল উদ্যোক্তার অপরিহার্য গুণ বা বৈশিষ্ট্য। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের এ যুগে বিভিন্নমুখী যোগাযোগ দক্ষতা ছাড়া কারও পক্ষেই অন্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
১০. সামাজিক দায়িত্ববোধ (Social responsiveness) : সমাজের প্রতি করণীয় রয়েছে উদ্যোক্তার এই বোধ বা চিন্তাকে উদ্যোক্তার সামাজিক দায়িত্ববোধ বলে । একজন উদ্যোক্তাকে সফলতা লাভে সমাজের বিভিন্ন পক্ষের সাথে কাজ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের প্রতি দায়িত্ব পালনের স্বাভাবিক অনুভূতি যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তার পক্ষে সংশ্লিষ্টদের সহানুভূতি অর্জন সম্ভব হয় না। আর এরূপ সহানুভূতি ও সহযোগিতা ছাড়া একজন উদ্যোক্তা সফল হতে পারে না ।
১১. মূল্যবোধ ও নৈতিকতা (Values and ethics): কোনটা ভালো এবং কোনটা মন্দ এ সংক্রান্ত উদ্যোক্তার বোধকে মূল্যবোধ এবং ভালোকে গ্রহণ ও মন্দ এড়িয়ে চলাকে নৈতিকতা বলে । একজন উদ্যোক্তাকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গুণসম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। অন্যায় ও অসৎ চিন্তা ও আচরণ দিয়ে কারও পক্ষেই বেশিদূর এগুনো সম্ভব নয়-এ ভাবনা উদ্যোক্তার মধ্যে থাকার প্রয়োজন পড়ে ।
১২. সাংগঠনিক জ্ঞান ও দক্ষতা (Organizational knowledge and ability): মানবীয় ও বস্তুগত উপকরণাদিকে কার্যকরভাবে সংহত করে সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং যোগ্যতার সাথে তা পরিচালনা করার সামর্থ্যকেই সাংগঠনিক জ্ঞান ও দক্ষতা বলে। নতুন উদ্যোগ সফল করার জন্য একজন উদ্যোক্তাকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মানবীয় ও বস্তুগত উপকরণাদি সংগ্রহ ও সমন্বিত করতে হয়। এক্ষেত্রে বাস্তবায়ন পর্যায়ের কোনো ভুল নানান বিপত্তির সৃষ্টি করে । এজন্য একজন সফল উদ্যোক্তাকে অবশ্যই উপযুক্ত সাংগঠনিক জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী হতে হয় ।
একজন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে সকল গুণ থাকা প্রয়োজন ব্যক্তির মধ্যে তা আছে কি না, থাকলে কোন মাত্রায় রয়েছে, ঘাটতি থাকলে তা কতটা পূরণ সম্ভব- এ সকল বিষয়ে ব্যক্তির নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণকে উদ্যোক্তার আত্মবিশ্লেষণ বলে।
ব্যবসায় ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। একজন নতুন মানুষ নতুন চিন্তা নিয়ে যখন ব্যবসায়ে নামে তখন তার ঝুঁকির মাত্রা স্বভাবতই বেশি হয় । তাই একজন উদ্যোক্তাকে আবেগপ্রবণ না হয়ে অত্যন্ত সচেতনভাবে তার নিজের অবস্থা মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। তাকে বুঝতে হয় এর সাফল্যের সকল কৃতিত্ব ও মুনাফার দাবি যেমনি তার তেমনি ব্যর্থতার সকল দায়ভারও তাকেই বহন করতে হবে। তাই উদ্যোক্তাসুলভ গুণ তার মধ্যে কোন মাত্রায় কতটা আছে, বা আছে কী নেই এবং ঘাটতি থাকলে তা কতটা পূরণ সম্ভব যথাযথ আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে তা চিহ্নিত করার প্রয়োজন পড়ে। এরূপ বিশ্লেষণের বিভিন্ন ধাপ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ধাপ-১: কৃতিত্বার্জন চাহিদা নির্ণয় : একজন ব্যক্তির মধ্যে কৃতকর্মে সাফল্যলাভের আকঙ্ক্ষাকেই কৃতিত্বার্জন চাহিদা বলে । একজন ব্যক্তি কর্মক্ষেত্রে কতটা সাফল্যলাভের কথা ভাবেন না শুধুমাত্র সকলের সাথে নিজেকে জুড়ে রাখতে চান-এর বিচারে ব্যক্তির কৃতিত্বার্জন চাহিদার মাত্রা বিবেচনা করা যায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বিশিষ্ট শিল্পমনোবিজ্ঞানী ডেভিড ম্যাকলিল্যান্ড এর মতে, 'কৃতিত্বার্জনের চাহিদা হলো ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা, স্বীয় কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে কৃতিত্বের আভ্যন্তরীণ অনুভূতি অর্জন।' একজন নতুন উদ্যোক্তা তার মধ্যে কৃতিত্বার্জনের চাহিদা কী পরিমাণে আছে তা বিশ্লেষণের জন্য নিজেই নিজের নিম্নোক্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো বিবেচনা করতে পারে :
উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তরগুলোতে যদি 'না' অপেক্ষা 'হ্যাঁ' বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে ব্যক্তির মধ্যে উচ্চমাত্রার কৃতিত্বার্জনের চাহিদা বিদ্যমান। তাই উক্ত উদ্যোক্তার জন্য একজন ভাল উদ্যোক্তা হওয়া অসম্ভব নয় ।
ধাপ-২: প্রশ্নের উত্তরের আলোকে প্রতিবেদন তৈরি : প্রথম ধাপের প্রশ্নের উত্তরগুলোর আলোকে একটা তালিকা বা প্রতিবেদন প্রস্তুত করলে দেখা যাবে যে, তা থেকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মিলিয়ে একটা ধারণার সৃষ্টি হবে। প্রতিটা ইতিবাচক উত্তরকে ১ এবং নেতিবাচক উত্তরকে ০ ধরলে একটা মান বেরিয়ে আসবে। অতঃপর উদ্যোক্তার যে সকল গুণ; যেমন- প্রজ্ঞা, সাহস, ধৈর্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইত্যাদি সাধারণভাবে থাকার প্রয়োজন বলে মনে করা হয় তার সাথে প্রতিবেদনের ধারণাকে মিলালে প্রতিটা ক্ষেত্রে ব্যক্তির শক্তি ও দুর্বলতা চিহ্নিত হবে । যা তাকে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করবে।
ধাপ-৩: প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তার সাথে মত বিনিময় এ পর্যায়ে স্থানীয় একজন সফল উদ্যোক্তার সাথে মতবিনিময় করা হলে পূর্বে তৈরিকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখিত প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে আরো বাস্তবসম্মত ধারণা লাভ সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে মত বিনিময়ে ব্যক্তিকে নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে হয় :
ধাপ-৪: প্রশিক্ষকের সহায়তা গ্রহণ : এ পর্যায়ে একজন সম্ভাব্য উদ্যোক্তা আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে সফল উদ্যোক্তার ইতিবাচক যে সকল গুণ তার মধ্যে দেখতে পায় সেগুলোকে সার্বিকভাবে কাজে লাগানোর উপায় সম্পর্কে প্রশিক্ষক বা পরামর্শকের এ পর্যায়ে সহায়তা নিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষকের নিকট থেকেও গুণাবলির তালিকা সংগ্রহ করে ব্যক্তি তার চিন্তাকে আরও ফলদায়ক করতে পারে। দুর্বল দিকগুলো এক্ষেত্রে কাটিয়ে উঠে গুণগুলোকে আরও কিভাবে বিকশিত করা যায় সে সম্পর্কেও সে এ পর্যায়ে ধারণা নিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষকের নিকট থেকে নিম্নোক্ত বিষয় জানলে সুবিধা হয়:
প্রশিক্ষকের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা লাভের পর একজন সম্ভাব্য উদ্যোক্তা তার গুণাবলি শনাক্তকরণের সাথে তার করণীয় বিষয়েও একটা সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেন। যা তাকে উদ্যোগ গ্রহণে সাহসী করে তোলে ।
মানুষ পরিবেশের দাস। অনুকূল পরিবেশে মানুষের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটে। সমাজ, অর্থনীতি, ব্যবসা- বাণিজ্যসহ সর্বত্রই তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে তার বৈপরিত্য লক্ষ করা যায় । মানুষ তার উৎসাহ-উদ্যম হারায়। নেতিবাচক চিন্তা ও হতাশা মানুষকে আচ্ছন্ন করে। ব্যবসায় উদ্যোগের সাথে যেহেতু ঝুঁকির প্রশ্ন জড়িত তাই ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণে একজন ব্যক্তি স্বভাবতই অনুকূল পরিবেশের প্রত্যাশা করে। এরূপ পরিবেশ বলতে নিম্নোক্ত উপাদানসমূহের উপস্থিতিকে বুঝানো হয়ে থাকে:
১. উন্নত অবকাঠামোগত সুবিধা (Advantages of developed infrastructure): ব্যবসায় উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে অবকাঠামোগত সুবিধা; যেমন- বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। এরূপ সুবিধাদি উন্নত হলে উদ্যোক্তারা নতুন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত হয়। বাংলাদেশে অনুন্নত অবকাঠামোর কারণে ব্যবসায় উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে ।
২. সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা (Govt. patronization): ব্যবসায় উদ্যোগকে সফল করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও গুরুত্বপূর্ণ । উন্নত দেশের সরকারসমূহ এরূপ উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ব্যবসায় বান্ধব নীতি প্রণয়ন, জামানতবিহীন ঋণদান, স্বল্পসুদে বা বিনাসুদে ঋণপ্রদান, কর অবকাশ, সহজে লাইসেন্সসহ ইউটিলিটি সুবিধা প্রদান ইত্যাদির ব্যবস্থা করে থাকে । এতে নতুন উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হয় ।
৩. আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা ( Socio-economic stability) : ব্যবসায় উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দেশের আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পৃথিবীর যে সকল দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান সেখানে সামাজিক অস্থিরতার মাত্রা কম থাকে। ফলে ব্যবসায়ীরা পরিকল্পিতভাবে স্বল্পমাত্রার ঝুঁকির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে । কিন্তু আমাদের মতো দেশে আর্থ-সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসায় উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করে।
৪. অনুকূল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি (Favourable law & order situation) : আইন শৃঙ্খলার সাথেও ব্যবসায় উদ্যোগ বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। যেখানে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য লক্ষণীয়, বিচার ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর মানুষের আস্থা নেই, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবসময় পথ চলতে হয়- সেখানে ব্যবসায় উদ্যোগ কখনই উৎসাহিত হতে পারে না। তাই এরূপ উদ্যোগ গড়ে উঠতে অনুকূল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিকল্প নেই ।
৫. পর্যাপ্ত পুঁজির প্রাপ্যতা (Availability of sufficient capital) : ব্যবসায় উদ্যোগের ক্ষেত্রে পুঁজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । নতুন উদ্যোক্তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুঁজির সংকটে ভোগে। তাই পর্যাপ্ত পুঁজির যোগান দিতে না পারায় একসময় ভালো উদ্যোগও সফল হতে পারে না। যে সমাজে মানুষের আয় ও সঞ্চয় বেশি, সেখানে সঞ্চয় থেকেই পুঁজির অংশবিশেষ আসতে পারে। এছাড়া ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে এ ধরনের উদ্যোক্তাদের সহজে ঋণ দেয়, সরকারও নানানভাবে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়- সেখানে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় উদ্যোগ উৎসাহিত হয়।
৬. উপকরণাদির সহজ প্রাপ্যতা (Availability of means of production) : পুঁজির প্রাপ্যতার সাথে উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ; যেমন- ভূমি শ্রম, কাঁচামাল, ইত্যাদির প্রাপ্যতাও ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ । উর্বর জমি কৃষি শিল্প গড়তে উৎসাহ দেয়। সস্তা শ্রমিকের কারণে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠছে। বাঁশ, বেত ইত্যাদি পর্যাপ্ত থাকায় সিলেট বা চট্টগ্রামে এরূপ হস্ত শিল্প গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ রয়েছে।
৭. বাজার সুবিধা (Market facilities) : ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার ক্ষেত্রে বাজার সুবিধা গুরুত্বপূর্ণ বাজার বলতে নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো পণ্য বা সেবার চাহিদাকে বুঝানো হয়। বাংলাদেশ প্রায় ষোল কোটি লোকের দেশ হওয়ায় এখানে স্বাভাবিকভাবেই পণ্য ও সেবার একটা বড় বাজার রয়েছে। তাই এখানে ব্যবসায়। উদ্যোগ উৎসাহিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের বিদেশে বড় বাজার থাকায় এখানে অনেক উদ্যোক্তা নানান প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও এ ব্যবসায় উদ্যোগকে সফল করতে সমর্থ হয়েছে।
৮. প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের সুযোগ (Opportunity of training & development) : নতুন উদ্যোক্তাদেরকে উৎসাহ দান ও তথ্য প্রদানের জন্য প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ কেন্দ্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় । এখানে থেকে সম্ভাব্য উদ্যোক্তারা নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে ও তার বাস্তবায়নের কৌশল সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় উদ্যোগ উৎসাহিত হয়। উল্লেখ্য অনেক দেশ এক্ষেত্রে যথেষ্ট এগিয়ে। ফলে সে সকল দেশে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণির বিকাশ লক্ষণীয় ।
বাবা ছোট চাকরি করেন । ভাই-বোনের মধ্যে বড় সামিয়া ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আর লেখাপড়া করবে না সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার ভাবনা বাবার পাশে না দাঁড়ালে ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। ক'দিন চাকরির জন্য বিভিন্ন স্থানে ঘুরলেও সুবিধা হয়নি। এক বড় বোনের পরামর্শে সে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সেলাই ও এমব্রয়ডারির ওপর দু'টি কোর্স শেষ করলো । অতঃপর এলাকার স্বল্পশিক্ষিত কিছু মহিলাকে সে নিজেই কাজ শিখালো । শহরের কিছু উঠতি ফ্যাশন হাউজের মালিকের সাথে যোগাযোগ করলো । দেখলো ভালো কাজের প্রতি তাদের যথেষ্ট আগ্রহ। এর মধ্যে ঘুরে সে বেশ কিছু সেলাই ও এমব্রয়ডারি কেন্দ্র থেকে অভিজ্ঞতা নিলো । অতঃপর কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ে নেমে পড়লো । তার বিভিন্ন ধরনের নতুন এমব্রয়ডারির কাজ অল্প দিনেই তাকে ফ্যাশন হাউজগুলোর নিকট জনপ্রিয় করে তুলেছে । এক্ষেত্রে সামিয়ার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ব্যবসায় উদ্যোগ যা তার আত্মকর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেছে ।
স্ব-উদ্যোগে নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাকেই আত্মকর্মসংস্থান বলে । সক্ষম প্রতিটা মানুষকেই তার জীবিকা অর্জনের জন্য কোনো না কোনো কাজ করতে হয় । কেউ চাকরি খুঁজে নেয়, কেউ ব্যবসায় করে, আবার কেউ কারও অধীনে শ্রম বা মেধা বিক্রয় না করে নিজেই নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। অন্যের অধীনে চাকরি বা কাজ করার অর্থ হলো কর্মের ঐ ক্ষেত্রটা সৃষ্টি করেছে অন্য ব্যক্তি। তাই উক্ত কর্মসংস্থানে তার কোনো ভূমিকা নেই । কিন্তু যখন কেউ স্ব-উদ্যোগে নিজেই নিজের কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে তখন তা আত্মকর্মসংস্থান বলে বিবেচিত হয় । একজন আর্কিটেক্ট নিজেই কাজ জোগাড় করে ড্রয়িং ও ডিজাইনের কাজ করছেন । একজন ডাক্তার চাকরি না করে নিজেই চেম্বার খুলে রোগী দেখছেন, একজন নিজেই একটা টেম্পু কিনে চালান- এক্ষেত্রে আর্কিটেক্ট যদি অন্যদের সাথে মিলে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম গড়ে তোলেন, ডাক্তার যদি হাসপাতাল গড়েন, টেম্পু চালক যদি কতকগুলো ট্যাম্পু কিনে তা ভাড়া দিয়ে আয় উপার্জন করেন-তবে প্রতিটা ক্ষেত্রে মুনাফার উদ্দেশ্য কাজ করায় ও ঝুঁকি থাকায় তা ব্যবসায় উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ আত্মকর্মসংস্থান একটা বৃহৎ ধারণা যেখানে ব্যবসায় উদ্যোগ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের প্রয়াস । তবে ব্যক্তির জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে বিবেচনা করলে আত্মকর্মসংস্থান শুধুমাত্র নিজের উন্নয়ন সম্পৃক্ত। কিন্তু ব্যবসায় উদ্যোগ সমাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অবদান ছিল মাত্র ১৫.৩৩%। শিল্প ও সেবা খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ৩১.২৮ % ও ৫৩.৩৯%। এ তথ্যই প্রমাণ করে, ব্যবসায় ইতোমধ্যেই সকল সমাজে ও অর্থনীতিতে শক্ত ভিত গড়তে সমর্থ হয়েছে। এ পর্যায়ে যদি কোনো দেশ ব্যবসায় উদ্যোগকে উৎসাহিত না করে, নতুন নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি যদি বের হয়ে আসতে না পারে অথবা ব্যবসায়ী সমাজ যদি নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে ব্যবসায় সম্প্রসারণ করতে ব্যর্থ হয়- তবে ঐ দেশের উন্নতির চিন্তা অবাস্তব । সেজন্য সকল দেশেই ব্যবসায় উদ্যোগকে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। একটা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যবসায় উদ্যোগের গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ক) অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance) : মানুষ আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে এবং দেশের আয় ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায় এমন গুরুত্বের বিষয়কেই অর্থনৈতিক গুরুত্ব বলে। ব্যবসায় উদ্যোগের অর্থনৈতিক গুরুত্ব যে সকল ক্ষেত্রে লক্ষণীয় তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
খ) সামাজিক গুরুত্ব (Social importance) : সমাজের মানুষের প্রয়োজন পূরণে কাজে লাগে বা বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলায় সহায়তা দেয় এমন প্রয়োজনীয় বিষয়কেই সামাজিক গুরুত্ব হিসেবে দেখা হয় । ব্যবসায় উদ্যোগের সামাজিক গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হলো:
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পোদ্যোক্তার গুরুত্ব অপরিসীম। তবে শিল্পোদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য একদিকে যেমন উদ্যোগী মানুষের প্রয়োজন অন্যদিকে প্রয়োজন শিল্পোদ্যোগ পরিবেশের। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ । উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রের ন্যায় শিল্পোদ্যোগেও অনেক সমস্যা দেখা যায় । নিম্নে বাংলাদেশে শিল্পোদ্যোক্তা বা ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা উন্নয়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. উদ্যোগ বিষয়ক শিক্ষার অভাব (Lack of entrepreneur related education): শিল্প বা ব্যবসায় উদ্যোগে সাধারণ জনগণকে আগ্রহী করে তোলার জন্য এদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো শিক্ষা কার্যক্রম নেই । কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগও সীমিত। সাধারণ শিক্ষায় ব্যবসায় উদ্যোগ, আত্মকর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয় নেই বললেই চলে । বাণিজ্য শিক্ষায় এ বিষয়টা ইদানিং অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাতে ব্যবহারিক শিক্ষার সুযোগ নেই । ফলে ব্যবসায় উদ্যোগের ক্ষেত্রেও এটি বড় বাধা হয়ে রয়েছে ।
২. প্রশিক্ষণের অভাব ( Lack of training) : শিল্পোদ্যোগে মানুষকে উৎসাহী ও নতুন উদ্যোক্তাদের তাদের উদ্যোগে সফল করতে যে প্রশিক্ষণ সুবিধার প্রয়োজন বাংলাদেশে তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যুব অধিদপ্তরসহ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান এ লক্ষ্যে কিছু কাজ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। দু-একটা এনজিও কিছু কাজ করলেও তা যথেষ্ট নয় ।
৩. সরকারি সাহায্য-সহযোগিতার অভাব (Lack of Govt, assistances) : বাংলাদেশে শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা নেই বললেই চলে। খাতা-কলমে প্রোগ্রাম থাকলেও ব্যবসায় উদ্যোগ সফল করতে এবং নতুন উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আনতে সরকারের যে ধরনের উৎসাহমূলক, সমর্থনমূলক ও সংরক্ষণমূলক সেবা সহায়তার প্রয়োজন তার যথেষ্ট ঘাটতি বিদ্যমান।
৪. মূলধনের অভাব (Lack of capital) : ব্যবসায় বা শিল্পোদ্যোগের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো পর্যাপ্ত মূলধনের ব্যবস্থাকরণ । বাংলাদেশের মানুষের সঞ্চয়ের সামর্থ্য কম হওয়ায় একদিকে যেমনি উদ্যোক্তার নিজস্ব মূলধন কম থাকে, তেমনি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মূলধন সরবরাহে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহ দেখায় না । কর্মসংস্থান ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড এক্ষেত্রে কিছু কাজ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তাদের কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত ।
৫. আইনগত জটিলতা (Legal complexity) : আমাদের দেশে শিল্পোদ্যোগ প্রক্রিয়ায় প্রকল্প গ্রহণ থেকে শুরু করে তা বাস্তবায়ন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে একজন উদ্যোক্তা নানান আইনগত ও বৈষয়িক জটিলতার সম্মুখীন হয় । যেমন- ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য বিভিন্ন লাইসেন্স সংগ্রহে, ঋণ গ্রহণে, সরকারি সেবা সুবিধা পেতে জটিলতা ইত্যাদি । এ সকল জটিলতা দূর করতে না পারলে এদেশে শিল্পোদ্যোগ কার্যক্রম কখনও ত্বরান্বিত হবে না ।
৬. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ( Lack of political stability) : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা শিল্পোদ্যোগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত প্রয়োজন । স্থিতিশীল রাজনীতিতে জনগণ স্বচ্ছন্দে ব্যবসায়- বাণিজ্য করতে পারে । ফলে একজন ব্যবসায়ী নতুন নতুন চিন্তা-চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক অঙ্গন প্রায় সব সময়ই উত্তপ্ত থাকে যা শিল্পোদ্যোগের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৭. প্রচার-প্রচারণার অভাব (Lack of publicity) : ব্যবসায় উদ্যোগকে উৎসাহিত ও এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও আগ্রহ সৃষ্টির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা থাকা দরকার তারও যথেষ্ট অভাব এ দেশে লক্ষণীয়। গণমাধ্যমগুলোতে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, দুর্ঘটনা, হরতাল রাজনৈতিক বক্তব্য- বিবৃতি যেভাবে প্রাধান্য পায় ভালো খবর, ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতি ও সফল উদ্যোক্তাদের সাফল্য গাঁথা সেভাবে প্রচারিত হয় না । ফলে নতুনদের চিন্তার জগতে ব্যবসায় উদ্যোগ নাড়া দিতে পারছে না ।
বাংলাদেশ একটা সম্ভাবনার দেশ। এদেশের তরুণ ও যুব সমাজ মেধা ও মননের দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর মানুষের চাইতে খুব পিছনে এটা বলার কোনোই সুযোগ নেই। ব্যবসায় উদ্যোগের সুফল বুঝতে পারলে এবং ব্যবসায় উদ্যোগ পরিবেশ উন্নত করা গেলে এ দেশের যুবশক্তি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাবলি দূর করার উপায় নিয়ে উল্লেখ করা হলো:
রায় বাহাদুর রণদা প্রসাদ সাহা বাংলাদেশের একটা সাধারণ সাহা পরিবারের সন্তান ছিলেন । ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার সাভারের উপকণ্ঠে কাছুর পল্লীতে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম । পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে । তাঁর পিতা দেবেন্দ্র পোদ্দার ছোট ব্যবসায়ী ছিলেন। অভাবের সংসারে রণদা প্রসাদ বাল্যকালে দুর্দান্ত প্রকৃতির হওয়ায় তাকে নিয়ে মাঝে-মধ্যেই পরিবারে অশান্তি হতো । শুনা যায়, এক অপরাধের কারণে তাঁর বাবা তাঁকে একবার খড়ম ছুড়ে মারেন । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই খড়ম গিয়ে তাঁর মায়ের কপালে লাগে। সেই আঘাতে তার মায়ের জ্বর এবং ধনুষ্টঙ্কার রোগ হয় এবং কয়েকদিনের মধ্যেই মা কুমুদিনী দেবী ইহলোক ত্যাগ করেন । মায়ের এই অপমৃত্যু এবং আত্মীয়-স্বজনদের তার প্রতি ক্ষোভ ও চরম নির্লিপ্ততা বালকের মনে এক তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে- যা তিনি সারা জীবনেও ভুলতে পারেননি ।
তখনকার দিনে সাহা পরিবারের ছেলেমেয়েদের বেশি লেখাপড়া শিক্ষা দেয়া হতো না । তাই নিম্ন-প্রাইমারির অধিক শিক্ষা তিনি পাননি। ১৯১৪ সনে ইউরোপে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে বাড়ি হতে পালানোর এক সুযোগে যুদ্ধে লোক নিয়োগের অফিসে তিনি তার নিজের নাম লেখালেন। পরে তাকে বেঙ্গল এ্যাম্বুলেন্স কোরে পুরুষ নার্স হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তিনি মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে আহত কয়েকজন সৈনিকের প্রাণরক্ষা করেন। এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ যুদ্ধ শেষ হলে রণদা প্রাসাদকে স্বয়ং রাজার সঙ্গে করমর্দনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এটাই তাঁর প্রথম ইংল্যান্ড সফর।
যুদ্ধে অংশগ্রহণের পুরস্কার হিসেবে প্রথম মহাযুদ্ধ ফেরত সকল ভারতীয়কেই ইংরেজরা তাদের যোগ্যতা অনুসারে কোন না কোন সরকারি চাকরিতে যোগদান করার সুযোগ দেয়। মি প্রসাদের লেখাপড়া নিম্ন প্রাইমারিতে শেষ হলেও যুদ্ধে তার কৃতিত্ব বিবেচনায় রেলের টিকেট কালেকটরের চাকরি দেয়া হয় । অবশ্য এই চাকরিটি তাঁর বেশিদিন থাকেনি। একটি মামলায় পড়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৩২ সালে তাঁকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছিল। চাকরি জীবনের অবসানের পর কলকাতায় তিনি ছোট একটি কয়লার ব্যবসায় শুরু করলেন। এটাই তাঁর ব্যবসায় জীবনের শুরু ।
রণদা প্রসাদের একটি আশ্চর্য গুণ ছিল এই যে, যে ব্যবসায় অন্য লোকেরা চালাতে না পেরে স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করে দিত, সুযোগ মতো তিনি তা কিনে নিজ দক্ষতা ও ঐকান্তিকতা দ্বারা স্বচ্ছল অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতেন । হয়তোবা ব্যবসায়ী গোত্রের লোক বলেই সম্ভবত তিনি যেকোন ব্যবসায়ের প্রধান সাংগঠনিক সমস্যাগুলো বুঝতে ও দ্রুত সমাধান করতে পারতেন। তিনি এ কয়লার ব্যবসায় যখন করছিলেন, সেই সময় একদিন লক্ষ করলেন, তাঁর জনৈক খরিদ্দার লঞ্চের মালিক বেশ কিছুদিন ধরে আর কয়লার দাম পরিশোধ করতে পারছেন না। তিনি নিজেই উক্ত লঞ্চটি ক্রয় করলেন। লঞ্চ ব্যবসায় কিছুকাল চললে দেখা গেল পুরানো লঞ্চ সারাবার জন্য প্রায়ই ডকইয়ার্ডে প্রচুর পয়সা দিতে হয়। যদি ডকইয়ার্ড বানানো যায়, তবে নিজের ব্যয় কমবে এবং অন্যদের কাজ করে আয় করা যাবে- এ চিন্তাতেই পরে তিনি ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন । এভাবে কয়লা হতে লঞ্চ এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে লঞ্চ মেরামতের ডকইয়ার্ড তাঁর ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত হয় ।
বেশ ক'টি ব্যবসায় একত্রে যুক্ত হলেও এগুলো সুষ্ঠুভাবে চালানোর মত অর্থ তখন তাঁর কাছে ছিল না । তৎকালীন কয়েকজন বিত্তশালী বাঙালি অর্থের যোগানদারকে তিনি অংশীদার করেন এবং তাদের সহযোগে বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি চালু করেন । এই কোম্পানির অন্যান্য অংশীদার ছিলেন মহেড়ার জমিদার নৃপেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী, ড. বিধান চন্দ্র রায়, ধনপতি ও রাজনীতিক নলিনী রঞ্জন সরকার এবং জাস্টিস জে.এন. মজুমদার ।
এক সময় ব্যবসায়ে চড়া ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসায় সম্প্রসারণের সুযোগ আসে। তিনি বিষয়টা অন্যান্য অংশীদারদের জানালেন । কিন্তু অন্যরা ঝুঁকি গ্রহণ পছন্দ করলেন না । ফলে অন্যান্য অংশীদারদের টাকা পরিশোধ করে দিয়ে তিনি নিজেই এর মালিক হন এবং সমগ্র দায় ও ঝুঁকি নিজের কাঁধে নিয়ে ব্যবসায়কে এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য এ সময়েও তাঁর মোট মূলধনের পরিমাণ সহস্রের অঙ্কেই সীমাবদ্ধ ছিল, লক্ষের কোঠায় যায়নি।
বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানির কাজ ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নদীপথে মাল আনা-নেয়া করা । এ কোম্পানি যখন মধ্যম আকারে বেশ লাভজনক ব্যবসায় এসে পৌঁছেছে, সেই সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়। ১৯৪২ সালের দিকে বাংলাদেশে খাদ্যের মূল্য চড়তে শুরু করে এবং যুদ্ধ ক্রমশ বাংলাদেশের উপকণ্ঠে আসতে থাকে। জাপানিরা তখন ব্রহ্মদেশ (বর্তমান মায়ানমার) দখল করেছে। এই ব্রহ্মদেশই ছিল তখন ইংরেজদের চাউলের প্রধান ভরসা । তাই ব্রহ্মদেশ যখন তাদের হাতছাড়া হলো, তখন সামরিক বাহিনীর জন্য এবং বেসামরিক প্রশাসনের খাতিরে ইংরেজ সরকার তৎকালীন বেঙ্গল (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা হতে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য ক্রয় করার একটি পরিকল্পনা করে। এই সময় সরকারের পক্ষে খাদ্যশস্য খরিদ করার জন্য তৎকালীন বেঙ্গলে চারজন ক্রয়কারী এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। এই চারজন সংগ্রহকারীর মধ্যে রণদা সাহা একজন সংগ্রহকারী রূপে নিযুক্ত হন। এই সময় চাউলের মূল্য দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে এবং অনেক সময়ই আগাম ক্রয় করা চাউলের জন্য এজেন্টগণ বাজার দরে যে টাকা পেতেন তা অভাবনীয় মাত্রায় বেশি ছিল। ফলে ১৯৪৪ সালের মধ্যে রণদা সাহার অর্জিত মূলধনের পরিমাণ সে সময়ে কয়েক লক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। যখন উদ্বৃত্ত টাকার তিনি মালিক হলেন তখন তার মনে এক ভাবাত্তরের জন্ম নেয়। বিনা চিকিৎসায় মাতার মৃত্যু এবং যুদ্ধকালে সৈনিকদের দুঃসহ অবস্থা স্মরণ করে জীবন সম্পর্কে এক অদ্ভুত চেতনা তিনি অনুভব করেন । তাই তিনি প্রথমে ঠিক করলেন স্বগ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করবেন এবং নিজ সন্তানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন । তাই দ্বিতীয় কন্যা জয়া (পরে মিসেস জয়াপতি) কে উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃটেনে প্রেরণ করেন। ১৯৪৪ সালে রণদা সাহা মির্জাপুরের ভুতুড়ে খাল বলে পরিচিত এলাকায় একটি পঞ্চাশ বেডের হাসপাতাল এবং একটি দাতব্য ডিসপেন্সারি স্থাপন করেন । এর নাম ছিল শোভা সুন্দরী ডিসপেন্সারি ।
এ সময়ে নারায়ণগঞ্জে অতি প্রাচীন পাট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান জর্জ এন্ডারসন কোম্পানি তাদের পাটের ব্যবসায় তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে রণদা সাহা একে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে জর্জ এন্ডারসনের পাটের ব্যবসায় ক্রয় করেন এবং বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানির সাথে যুক্ত করে নারায়ণগঞ্জে পাটের বেইলিং, ভাড়া দেয়ার জন্যে পাটের গুদাম এবং একটি ডকইয়ার্ড চালু করেন ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তে তাঁর মোট খাটানো মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটি টাকার মত। কিন্তু ব্যবসায় বা টাকার মালিকানা তাঁকে তৃপ্তি দিতে পারেনি। তাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ ব্যবসায় হতে যে আয় হবে তা দ্বারা মায়ের নামে একটি দাতব্য ট্রাস্ট গঠন করেন । এটাই কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নামে খ্যাত। বর্তমানে বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি এই ট্রাস্টেরই একটি সম্পত্তি এবং ট্রাস্টেরই আয় হতে মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী হাসপাতালের স্কুল অব নার্সিং, টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ এবং এস.কে হাই স্কুল (ছেলেদের জন্য) পরিচালিত হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, মানিকগঞ্জের বিখ্যাত দেবেন্দ্র কলেজটিও তাঁর পিতার স্মৃতির রক্ষার্থে রণদা সাহাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কুমুদিনী হাসপাতালে বর্তমান প্রায় এক হাজার বেড রয়েছে এবং ভারতেশ্বরী হোমসে ছাত্রীদেরকে সম্পূর্ণ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয় । এখানে একত্রে এক হাজার ছাত্রী পড়াশুনা করে থাকে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিক্তশালী হিন্দুরা অনেকেই ভারতে চলে যান, কিন্তু রণদা প্রসাদ সাহা তাঁর মাতৃভূমি ত্যাগ করেননি। এমনকি ১৯৭১ সালে যখন দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি নিজে এবং মির্জাপুরের অনেক হিন্দু বিজ্ঞজন বাংলাদেশে থেকে মাতৃভূমির সেবা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন । যার ফল হয় খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ১৯৭১ সালে ৭ মে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ভবানী সাহাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং তাঁদের আর কোনো সন্ধানই পাওয়া যায়নি। জীবনযুদ্ধে সফল এই সৈনিক যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, মাতৃভূমিকে ভালোবেসেছিলেন, দেশের ও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন দেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তাঁর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ও মৃত্যু জাতির জন্য খুবই বেদনাদায়ক ।
বর্ণালী প্রতিভা ও গুণের অধিকারী সফল সমাজ উন্নয়ন কর্মী, দক্ষ সংগঠক ও সফল উদ্যোক্তা ড. হুসনে আরা বেগম দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি মহিলা উন্নয়ন সংগঠন TMSS (ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ) এর নির্বাহী পরিচালক ।
১৯৫৩ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি বগুড়া জেলার সদর উপজেলার ঠেঙ্গামারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাস করার পর ওয়াশিংটন ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন। তার কোর্স বিষয়ের নাম ছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ কাঠামোতে লিঙ্গ সাম্য ও সমতা (Gender equity & equality) উন্নয়নে TMSS (NGO) এর ভূমিকা। বগুড়ার নাসরাতপুর কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন এবং কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৮৫ সালে পূর্ণাঙ্গ একজন সমাজকর্মী হিসেবে TMSS এর কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১৯৮৫-১৯৯১ পর্যন্ত TMSS এর সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সাল থেকে TMSS এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
একটা গ্রাম থেকে কাজ শুরু করলেও TMSS তার সুযোগ্য পরিচালনায় বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় ২৮,৪০,৭৭৪টি পরিবারকে ইতোমধ্যে সহায়তা প্রদান করেছে। যার মধ্যে ১০,৬০,৮৫৪টি পরিবারকে উন্নয়ন সেবা এবং ১৭,৭৯,৯২০টি পরিবারকে ক্ষুদ্র ঋণ সেবা প্রদান করা হয়েছে। TMSS এর ২০ ধরনের ক্ষুদ্র ঋণ সেবা চালু রয়েছে । এছাড়া কৃষি, সামাজিক উন্নয়ন সেবা, মানবধিকার ও লিঙ্গ, মৎস্য ও গবাদি পশু, স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কার্যক্রম, শিক্ষা, কৃষি ও অকৃষি কার্যক্রম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি কর্মসূচি, পরিবেশ ও বনায়ন কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য । বৈশ্বিক ও দেশীয় বিভিন্ন সমস্যাকে সামনে রেখে TMSS এখন বিভিন্ন কর্মসূচি;
যেমন- দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গসমতা, মানব সম্পদ উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমানো, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে । ড. হুসনে আরা বেগম একজন দক্ষ সামাজিক সংগঠক হিসেবে TMSS এর সাথেই শুধু সংযুক্ত থাকেননি তিনি বগুড়ার আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে শুরু থেকেই কাজ করে এসেছেন। যেখানে যতটা সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই সমাজকর্মের সাথে সম্পৃক্ত থেকে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন । শিক্ষা জীবনেই তিনি আল-আমীন সমিতি নামে একটা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপার্সন হিসেবে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন । এরপর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ৩০টির অধিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য, PKSF (পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন) এর সদস্য, আনসার ভিডিপি ব্যাংকের পরিচালক সদস্য, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARK) এর গভর্নিং বডির সদস্য ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । তিনি বর্তমানে TMSS এর নির্বাহী পরিচালক ছাড়াও নারী উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রচণ্ড আত্মপ্রয়াসী ও কর্মনিষ্ঠ ড. হুসনে আরা বেগম সমাজ তথা নারী সমাজের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে যেয়ে বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন, প্রায় ২০টি দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যার মধ্যে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে গ্রামীণ মহিলা সংগঠন ও নেতৃত্ব পুরস্কার, ১৯৯৩ ও ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় জনসংখ্যা পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর বনায়ন পুরস্কার, ২০০৫ সালে মৎস ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রদত্ত জাতীয় মৎস্য পক্ষ স্বর্ণপদক পুরস্কার, জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা UNCDF কর্তৃক বৈশ্বিক ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার বাংলাদেশ ২০০৫ এর সম্মান অর্জন, ২০০৫ সালে PKSF কর্তৃক Best Partner Award, ২০০৭ সালে কেয়ারটেকার সরকার প্রধান থেকে Best Award for National Forestry 2007 এবং ২০০৯ সালে কেয়ারটেকার সরকার প্রধান থেকে বেগম রোকেয়া পুরস্কার ২০০৭ লাভ করেন ।
বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ। যেখানেই উদ্যোগ নিয়ে কোনো কাজে কেউ এগিয়ে গেছে দু'চারটে ব্যতিক্রম বাদ দিলে সেখানেই সফলতা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে এখন তার চিরায়ত গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তাই ব্যাপক প্রচারিত না হলেও নিরবে রচিত হচ্ছে অনেক সাফল্য গাঁথা । এদের অনেকেই আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কাজ শুরু করলেও এক পর্যায়ে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করছেন । এমনই দু'একজনের জীবন সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো :
কৃষকের ছেলে ভালো কৃষক হবে নতুন ফসল ফলাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চা শ্রমিক- যাদের জীবন সাধারণ কৃষক ও পেশাজীবী মানুষ থেকে ভিন্নতর তারা যদি সামান্য সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থেকে কৃষি ক্ষেত্রে নেমে সফল কৃষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও সম্মান লাভ করতে পারে তবে তা নিঃসন্দেহে গৌরবের। এমনই একজন সফল কৃষক কুমার দুধবংশী।
চা শ্রমিক সম্পর্কে যারা কিছুটা খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানেন তাদের জীবন কত কষ্টের । দৈনিক মাত্র ৪৮ টাকা মজুরি পেয়ে তা দিয়ে ১১ জন সদস্যের পরিবার চালিয়েছেন কুমার দুধবংশী। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার খাই ছড়া চা বাগানে আর পাঁচজন সাধারণ শ্রমিকের মত তারও জীবন ছিল ছকে বাধা। সকালে চা বাগান, চা পাতা সংগ্রহ, বাগান পরিচর্যার কাজ। আর সন্ধ্যা বেলায় পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধবের সাথে সুখ দুঃখের গল্প, হৈ-চৈ, আর সুযোগ পেলেই নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকা। কুমার দুধবংশীর মাথায় এলো সবাইতো এটা করছে । তাই ভিন্ন কিছু করা যায় কি না। চা বাগানের ভিতরে অনেক জমি এমনি পড়ে থাকে । সেখানে চাষবাস করে বাড়তি আয়ের চিন্তা নিয়েই তিনি প্রথমে কৃষিতে নেমে পড়েন। সব্জী চাষ দিয়ে শুরু হয় নতুন জীবন। তার বাগানে সারা বছর নানান ধরনের সব্জীর চাষ । বর্ষাকালে ঝিঙ্গা, করলা, বরবটি ইত্যাদির চাষ করেছেন। অন্য সময়ে বাধাকপি, টমেটো, আলু, লাউ ইত্যাদি চাষ হচ্ছে। বিক্রয় নিয়ে সমস্যা নেই। চা বাগানগুলোর হাজার হাজার শ্রমিক। তারাই তার ক্রেতা। তার কৃষি ক্ষেতে এক একটা পুষ্ট ঝিঙ্গার ওজন ৪০0 গ্রাম থেকে ৫৪০ গ্রাম । করলার ওজনও ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম। একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে তিন বছর কৃষি কাজ করার পর 'বিগত দু'বছরে তিনি স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেছেন। ২০১২ সালে রাজা টমেটোর চাষ করে তিনি এক লক্ষ টাকা আয় করেছেন। ঝিঙ্গা-করলা ইত্যাদি খাতেও লক্ষাধিক টাকা আয় হয়েছে । আলুর চাষ করে প্রায় ১০০ মণ আলু ফলিয়েছেন । এখন তার দেখাদেখি অনেকেই বাড়ির আশেপাশে ও পতিত জমিতে কৃষিকাজ করছে । তিনি এখন এলাকার একজন আদর্শ কৃষক ।
কঠোর পরিশ্রম, মেধা ও কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা থাকলে স্বল্প পুঁজি নিয়েও যে ভাগ্য বদল করা যায় তার বাস্তব প্রমাণ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জের পোল্ট্রি খামারি নিজাম । মাত্র ১২ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি পোল্ট্রি খামার করে বর্তমানে জেলার অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠিত পোল্ট্রি ব্যবসায়ী। তার পোল্ট্রি খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা ।
১৯৯৭ সালে স্থানীয় কলেজে বিএসএস (ডিগ্রি) শেষবর্ষের ছাত্র ছিলেন নিজাম। সংসারে ৪ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। মাথার ভেতর বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন তার। শখের বসে বাড়ির পাশে একখণ্ড জমিতে গড়ে তোলেন পোল্ট্রি খামার। পুঁজি ১২ হাজার টাকা। পড়াশোনার পাশাপাশি খামারে ব্রয়লার মুরগির লালন-পালন চলে ভালোভাবে। নিজ এলাকার চন্দ্রগঞ্জ বাজারে একটি দোকান নিয়ে শুরু করেন ব্রয়লার মুরগির খুচরা বিক্রি। ১৯৯৮ সালে ঢাকার লায়ন এগ্রো অফিসে ৩ দিনব্যাপী পোল্ট্রি বিষয়ক কর্মশালায় অংশ নিয়ে মুরগি পালন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। এরপর তার আরো আগ্রহ বেড়ে যায়। ছেলের পরিশ্রম, আগ্রহ ও পোল্ট্রি খামারের ব্যবসার ভালো অবস্থা দেখে বাবা হোসেন আহমেদ পুঁজি দিলেন আরো ৭০ হাজার টাকা। সেই থেকে গতি পায় তার ব্যবসায় । খামার প্রসারে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেন তার ছোট ভাই শাহাবুদ্দিন ।
সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির পোল্ট্রি খাদ্য ও মেডিসিনের ডিলার নিয়ে তিনি গড়ে ! তোলেন সোনালি ফিডস অ্যান্ড চিকস। এ ছাড়া উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের জাউডগা গ্রামে ১০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে মমতাজ এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। এখানে রয়েছে লেয়ার মুরগি ও মৎস্য খামার। এ খামারে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার ডিম উৎপাদন ও মৎস্য খামার থেকে বছরে ১০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করা - হয় । এ ছাড়া তার আরো কয়েকটি মুরগির খামারে দৈনিক ৮ থেকে ৯ হাজার ডিম উৎপাদন হয় । ডিম বিক্রি হয় - দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এ লেয়ার খামারগুলো গড়ে তোলা হয়েছে সদর উপজেলার নূরুলাপুর, জকসিন, বসুরহাট, চন্দ্রগঞ্জের লতিফপুর ও বেগমগঞ্জ উপজেলার আমিনবাজারে ।
এ ছাড়া সদর উপজেলার ৫৫টি ব্রয়লার মুরগি খামারে তার বিনিয়োগ রয়েছে। এসব খামারের মালিককে সম্পূর্ণ বাকিতে বাচ্চা, খাদ্য ও মেডিসিন দেওয়া হয়। পরে বাচ্চা পরিপূর্ণ হলে তা বিক্রি করে খামার মালিকরা নিজামের বকেয়া পরিশোধ করেন। ব্রয়লার মুরগি ও লেয়ারের ডিম লক্ষ্মীপুর ও পার্শ্ববর্তী জেলা নোয়াখালী ও ফেনীতে সরবরাহ হয়ে থাকে। নিজামের প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হওয়ায় প্রায় ৩৫টি পরিবারে আসে সচ্ছলতা । ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাসিক বেতন দেওয়া হচ্ছে আড়াই লাখ টাকা ।
সংগ্রামী মানুষের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। হতদরিদ্র রহিমা তাদেরই একজন। দিনমজুর বাবার বাড়ি ছিল পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার হাঁটুরিয়ার নাকালিয়ায় । রহিমা বাবার ঘরে থাকা অবস্থায় শেষ সম্বল ভিটাবাড়ি সর্বনাশা যমুনার করালগ্রাসে নিমজ্জিত হয় । অভাবী বাবা অপরিণত বয়সের রহিমাকে চাল-চুলাবিহীন রহিমের সঙ্গে বিয়ে দেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোলজুড়ে সন্তান আসে । দিশেহারা রহিম খাল-বিলে মাছ ধরে দিন যাপন করত। সেই সময়ও হাল ছাড়েননি রহিমা। স্বপ্ন দেখতেন একদিন একটি পুকুর লিজ নেবেন, সেখানে মাছ চাষ করে সন্তান লালন-পালন করবেন, সন্তানদের স্কুলে পড়াবেন, দু'বেলা পেট ভরে খাবেন । এ বিষয়গুলো গল্পের মতো মনে হলেও রহিমার কাছ থেকে শুনলে আরো বেশি মনে হয় ।
সরেজমিন জানা যায় পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা ইউনিয়নের রহিমা-রহিমের পরিবর্তনের কথা । রহিমা বলেন, ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আসিয়াব তাদের গ্রামে জরিপ চালায়। এ সময় হতদরিদ্র পরিবার হিসেবে তারা মনোনীত হয়। পরে ২৯ জন সদস্য নিয়ে জীবিকার সন্ধানে মহিলা উন্নয়ন সংগঠন নামে একটি দল গঠন করে আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন রহিমা । প্রশিক্ষণ শেষে অনুদান হিসেবে ১৪ হাজার টাকা ব্যবসায়ের জন্য এবং মাসিক জীবিকা সহায়ক ভাতা হিসেবে ২০ মাস ৫০০ টাকা হারে এবং দুর্যোগকালীন সহায়তা হিসেবে ৪ মাস ১ হাজার টাকা হারে মোট ২৮ হাজার টাকা পাবেন। রহিমা ব্যবসায়ের জন্য ১৪ হাজার টাকা পাওয়ার পর সেই টাকার সঙ্গে নিজের ছাগল ও হাঁস-মুরগি বিক্রয়ের টাকা মিলিয়ে মোট ২০ হাজার টাকা দিয়ে তিন বিঘার একটি পুকুর ১ বছরের জন্য লিজ নেন । সেই পুকুরে মাছের ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করেন। রহিমার কাছ থেকে জানা যায়, তিনি গত ৯ মাসে ৫৫ হাজার টাকার পোনামাছ ও মাছ বিক্রয় করেছেন । তার পুকুরের চারপাশে নেপিয়ার ঘাস ও লাউ বিক্রি করে অতিরিক্ত ১২ হাজার টাকা আয় করেন । আরো ৩টি পুকুর ৩০ হাজার টাকা দিয়ে লিজ নেন । যেখানে ৪০ হাজার টাকার পোনামাছ বড় করার জন্য চাষ করা হচ্ছে । রহিমার হিসাব মতে, বছর শেষে ৪টি পুকুর থেকে কমপক্ষে ২ লাখ টাকার মাছ বিক্রয় করবেন । উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এমন অসংখ্য রহিমা, যারা কি না আসিয়ারের হতদরিদ্রদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্পের সহযোগিতা পেয়ে নিজের জীবনে আমুল পরিবর্তন এনেছেন ।
সুমি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ছে । তার বইয়ে সে নারী উদ্যোক্তার কথা দেখলেও এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা কম দেখে সে খুবই হতাশ। সে দেখে গার্মেন্টসগুলোতে বেশির ভাগই নারী শ্রমিক । রাস্তায় উন্নয়নের কাজেও সে মেয়েদের দেখে তার মন বড়ই খারাপ হয়। সে দেখছে তার পরিচিত এক বড় বোন এলাকার মেয়েদের সংগঠিত করে তাদের সেলাই, এমব্রয়ডারি ও হাতের কাজ শিখিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। তাদের উৎপাদিত সামগ্রী তিনি প্রথমে কষ্ট করে ঢাকায় নিয়ে বিক্রয় করতেন । এখন আর তার প্রয়োজন পড়ে না । ঢাকায় থেকে অর্ডার দিয়ে লোকেরা এসে মালামাল নিয়ে যায়। সে ভাবছে তার এ বোনটি প্রকৃতই একজন নারী উদ্যোক্তা। সেও লেখাপড়া শিখে নারী উদ্যোক্তা হয়ে দেশের নারী সমাজকে এগিয়ে নেবে এটা সে ঠিক করে ফেলেছে।
নারী উদ্যোক্তা বলতে এমন কোনো নারীকে বুঝায় যিনি তার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে কোনো ব্যবসায়কে সংগঠিত ও পরিচালনা করেন । অনেক সময়ই নারীরা পুরুষের সহযোগী হিসেবে ব্যবসায় কাজে সহযোগিতা করে থাকেন । সেক্ষেত্রে তাদেরকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে দেখা হয় না। যিনি নিজের মালিকানায়, নিজের উদ্যোগে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ব্যবসায়কে সংগঠিত করে পরিচালনা করেন তাকে বাস্তবিক অর্থে নারী উদ্যোক্তা বলে । শিল্পনীতি ২০১০ এ প্রবর্তিত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এমন কোনো মহিলাকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গণ্য করা হবে। যিনি কোনো ব্যক্তিগত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক অথবা যৌথ উদ্যোক্তা (অংশীদার) বা কোম্পানির ক্ষেত্রে এর ৫১% শেয়ার মূলধনের মালিক। অর্থাৎ নারী উদ্যোক্তা হলেন এমন কোনো মহিলা যিনি নিজস্ব মালিকানায় কোনো একমালিকানা ব্যবসায় গড়ে তুলেছেন বা অংশীদারি ব্যবসায় বা কোম্পানি সংগঠন গড়ে তুললেও তার ৫১% শেয়ারের মালিক । অর্থাৎ শুধুমাত্র অংশীদারির খাতায় নাম থাকলে বা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হলেই তাকে নারী উদ্যোক্তা বলা যাবে না ।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ে নারী উদ্যোক্তার আগমন হার আশাব্যঞ্জক নয়। অথচ নারী-পুরুষ সমানভাবে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে না এলে একটা জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। গ্রামীণ ব্যাংকসহ এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো নারীর ক্ষমতায়নের চেষ্টায় নারীদের ঋণ দিচ্ছে। তাতে তারা নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কুটির শিল্প, পোলট্রি, ডেইরি, ছোট ব্যবসায় গড়ে তুলতে উৎসাহিত হচ্ছে । কক্সবাজারে গেলেই দেখা যাবে উপজাতি নৃগোষ্ঠীর মেয়েরা সুন্দরভাবে দোকান চালাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। বিদেশে এ হার অনেক বেশি। ব্যাপকভিত্তিতে মাহিলাদের উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রশিক্ষণসহ মূলধন সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছে। নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভবিষ্যতে নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসার হার উৎসাহব্যঞ্জক হারে বাড়বে এটা আশা করা যায় ।
একাগ্রতা, নিষ্ঠা আর কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিজেকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব- এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নারী উদ্যোক্তা রেহানা কাশেম। মাত্র ৬ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় শুরু করে এখন তার পুঁজি ৫০ লাখ টাকারও বেশি । নারী উদ্যোক্তাদের কাছে তিনি এক অনন্য আদর্শ ।
একজন সাধারণ গৃহবধু হিসেবে অবসর সময়ে কুশন কভার, টেবিল ম্যাট, ন্যাপকিন ইত্যাদি তৈরি করতেন । প্রতিবেশী এবং বন্ধু-বান্ধবদের কাছে তার এই কাজগুলো ছিল পছন্দের। তারাও অনুরোধ করতেন এসব ডিজাইনের পণ্যগুলো তাদের তৈরি করে দিতে। নিজের এই মেধা এবং সৃজনশীলতাকে পুঁজি করে ১৯৮২ সালে অপেশাদারভাবেই তিনি শুরু করেন হস্তশিল্প ব্যবসায়। কিন্তু হঠাৎ করেই স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় এবং বাজার থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে তিনি পুরোপুরি পেশাদারিভাবেই এই ব্যবসায় শুরু করেন। এ সময় তার প্রাথমিক পুঁজি ছিল মাত্র ৬ হাজার টাকা । মেয়েদের পোশাক ডিজাইনিংয়ে মনোযোগ দেন তিনি। ১৯৮৫ সালে এসে তার পুঁজি দাঁড়ায় প্রায় ৬ লাখ টাকা। এ বছর তিনি তার ব্যবসাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন সাতরং হ্যান্ডিক্রাফটস অ্যান্ড ফ্যাশন নামে । এ সময় প্রথম অর্ডারটি পান ফ্যাশন হাউস ভূষণের কাছ থেকে । তার কাজে মুগ্ধ হয়ে ভূষণের স্বত্বাধিকারী তাকে পাঞ্জাবি তৈরি করার কার্যাদেশ দেন। সেই থেকে শুরু । আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে । ১৯৯৫ সালে তিনি মাইডাস থেকে ২ লাখ টাকা জামানতবিহীন ঋণ পেলেন । মাইডাসের এই ঋণের মাধ্যমে তিনি তার সেলাই মেশিনের সংখ্যা বাড়িয়ে নিলেন ১৮ থেকে ৩৭-এ । অল্পদিনের মধ্যে তার একাগ্রতা এবং ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি মাইডাসের শীর্ষ ব্যক্তিদের নজরে এলো। তারা তাকে একজন ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচনা না করে তার ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক বাড়ানোর কাজে সহায়তা করলেন। মাইডাস মিনি মার্টের সদস্য হলেন তিনি। এভাবে তার পোশাক সমাজের আরেকটি বড় অংশের কাছে পরিচিতি পায় এবং প্রশংসা কুড়ায় । সময়ের ব্যবধানে মাইডাস তাকে পুনরায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা ঋণ দেয় ।
মাত্র ৬ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসায় শুরু করে রেহানা কাশেমের নিজস্ব পুঁজি এখন প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। বর্তমানে ঢাকার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তার প্রতিষ্ঠানের শোরুম রয়েছে। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন প্রায় ৩শ কর্মী। তার প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার এখন দেড় কোটি টাকা। ব্যবসায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রেহানা কাশেম একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০০ সালে জবস, ইউএসএইড, ২০০১ সালে ডেইলি স্টার অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৩ সালে অনন্যা বিজনেস অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন তিনি ।
একটু চিন্তা ও চেষ্টা থাকলেই যে কিছু করা সম্ভব তার প্রমাণ বরিশালের রাধা রাণী ঘোষ। মাত্র এসএসসি পাস পরিশ্রমী ও সাহসী নারী এখন নগরীর অমৃত লাল দে সড়কের নতুন বাজার এলাকায় মেসার্স রাধা বস্ত্রালয় নামক একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী । রাধা রাণীর স্বামী ছোট একটি রেস্তোরা চালাতেন। সংসারে টানাটানি ঘুচাতে রাধা রাণী প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। ঘটনাক্রমে ভাইয়ের সাথে ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবাজার থেকে কয়েকটি শাড়ী কিনলেন নিজের ও প্রতিবেশীদের জন্য। শাড়ীগুলো খুব পছন্দ হলো তাদের। আর সেখান থেকেই ঘুরে গেল রাধা রানীর জীবনের মোড়। ঢাকা থেকে শাড়ী কিনে ঘরে বসেই বিক্রি করতে শুরু করলেন। টিউশনি ছেড়ে শাড়ি ও বাচ্চাদের পোষাকের একটি দোকান দিলেন। ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের জন্য বেসিক ব্যাংক, বরিশাল শাখা থেকে ২ লাখ টাকা এসএমই ঋণ নেন। পরবর্তিতে আরো ৩ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসায়ের প্রসার ঘটিয়েছেন।
সৃষ্টিকর্তার অমোঘ বিধানে যে কোনো সমাজেই নারী-পুরুষের হার মোটামুটি সমান। তাই দেশের ৫০% জনসংখ্যাকে দেশের উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করা ব্যতিরেকে কোনো দেশের পক্ষেই কার্যত অগ্রগতি লাভ সম্ভব নয়। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের সরকার বেশ আগে থেকেই নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. প্রশিক্ষণ সুবিধা (Training facilities) : নারী সমাজকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী ও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে । জুলাই ২০১০ থেকে জুন ২০১৩ মেয়াদে বাস্তবায়নাধীন জেলা পর্যায়ের মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (WTC) সমূহের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ৬৪টি জেলার বিদ্যমান মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উন্নয়ন ও বৃত্তিমূলক আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। এছাড়া নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৪৬টি জেলায় ইতোমধ্যেই ২৭,৬০০ মহিলারে প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্যে কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে । এছাড়া জাতীয় মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন একাডেমি বিভিন্ন ট্রেডে মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে । এছাড়া যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতায় যুব ও যুব মহিলাদের বিভিন্ন । ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
২. অর্থ প্রদান সহায়তা (Fanancing facilities) : যে সেকল নারীরা নিজেদেরকে স্বাবলম্বী ও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ইচ্ছুক, প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের সেজন্য প্রস্তুত করছে তাদের সরকারের পক্ষ থেকে ঋণ ও আর্থিক সুবিধা দেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প কাজ করছে। জাতীয় মহিলা সংস্থার আওতাধীন স্বকর্ম সহায়ক ঋণ কার্যক্রমের অধীনে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে প্রত্যেক নারীকে ৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে । মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি জেলার ৪৭৩টি উপজেলায় প্রত্যেক নারীকে ৫,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে । নগরভিত্তিক প্রাস্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নারীদের ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া ] হয় । বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে কৃষি ও এসএমই (Small and Middle Enterprise) ঋণ বিতরণে তাদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এই স্কীমের আওতায় নারী উদ্যোক্তাদের ১০% সুদে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গ্যারান্টির বিপরীতে পঁচিশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে । ২০১৪-১৫ সালে এই স্কীমের আওতায় নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৩,৯৬৭.৯২ কোটি টাকা এসএমই ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে ।